রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন

৫০০ কোটি টাকার সম্পদ ছাড়িয়েছে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির

৫০০ কোটি টাকার সম্পদ ছাড়িয়েছে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির

৫০০ কোটি টাকার সম্পদ ছাড়িয়েছে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির

ফয়সাল হাওলাদার: সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ,আলোচিত সরকারি কর্মকর্তা মতিউর রহমান, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল, ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ডিডি ফারজানা পারভিন, রাজবাড়ির সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ মাহাবুবুর রহমান ও ভালুকা মডেল থানার সাবেক ওসি মাহামুদুল ইসলাম, মাউশি’র ডিডি আব্দুল আজিজের মতো দুর্নীতির পথে হেঁটে সম্পদের চূড়ায় উঠেছেন আরেকজন। তিনি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডিশনাল আইজিপি) ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার। শুধু শামসুদ্দোহা একা নন, তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানাও দুর্নীতির ছায়ায় সম্পদে হয়েছেন শক্তপোক্ত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, এ দম্পতি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক।

 

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২৭ শতক জমি আছে তাদের নামে। দলিলে এসব জমির দাম ৭০ কোটি টাকা দেখানো হলেও আদতে বাজারদর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। গত ১৮ মার্চ আদালত তাঁর এসব সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ দেন। পরদিন তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করলে ওই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। শামসুদ্দোহা খন্দকার চাকরিজীবনে শুধু সম্পদের শিখরে উঠে দমে যাননি রাজধানীর বনেদি এলাকা গুলশানে অন্তত ২০০ কোটি টাকা দামের সরকারি জমি ও বাড়ি নিজের করে নিতে রকমারি কূটকৌশল চালাচ্ছেন। তাঁর প্রতাপের কাছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা আবাসন পরিদপ্তরও যেন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ। শামসুদ্দোহা ২০১১ সালে প্রেষণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান পদে বসে সীমাছাড়া দুর্নীতিতে জড়ান। এ পটভূমিতে ২০১৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা ঠুকে দেয় দুদক। ওই মামলায় স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানাও আসামি। মামলাটি এখনও চলমান। এ ছাড়া তাঁর রয়েছে হরেক রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য। তিনি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মালিকদের অন্যতম একজন। ২০২১-২২ সালের পরিষদে শামসুদ্দোহা ছিলেন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ ১১ কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর মধ্যে শামসুদ্দোহা খন্দকারও একজন।

 

 

দুদকের তদন্তে শামসুদ্দোহার নামে রাজধানীর খিলক্ষেত ও ঢাকার নবাবগঞ্জে ৩৫টি দলিলে ৫৬৩ শতকের বেশি জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এসব জমির বেশির ভাগই নবাবগঞ্জের কলাকোপায়। দলিলে এসব স্থাবর সম্পদের দাম ৪০ কোটির মতো হলেও বর্তমান বাজারদর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এর বাইরে তাঁর একটি কৃষি খামার ও গ্রিন পার্ক রয়েছে। দলিলে এ দুটির দাম প্রায় চার কোটি টাকা। শামসুদ্দোহার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা খন্দকারের নামে রাজধানীর নিকুঞ্জে তিন কাঠা, খিলক্ষেতে ২২ কাঠা, গুলশানের বিভিন্ন মৌজায় ৫৩ কাঠা জমির তথ্য পেয়েছে দুদক। এগুলোসহ গাজীপুর ও নবাবগঞ্জের বিভিন্ন মৌজায় মোট ৩২টি দলিলে তাঁর নামে ৪৬৪ শতক জমি রয়েছে।

 

 

দলিলে এসব জমির দাম ৩০ কোটি টাকার কিছু বেশি হলেও বর্তমান বাজারদর শতকোটি টাকার ওপরে। এছাড়াও রাজবাড়ির সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ মাহাবুবুর রহমান নিজ জেলা ময়মনসিংহের নগরীতে প্রায় ২২ কোটি টাকার জমি কিনে আলিশান বাড়ি নির্মান করেছেন। এ সম্পদ দুই জেলার সিভিল সার্জন থাকাকালে গড়েছেন। অভিযোগ আছে ডাঃ মাহাবুবুর রহমান ত্রিশাল ও ময়মনসিংহ নগরীতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার ন্ত্রী ত্রিশাল সরকারী নজরুল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জয়নব রেখা। তার নামে রয়েছে একাধিক ব্যাংক। এসব ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা জমা রেখেছেন।

 

 

আরেক রাঘববোয়াল ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ন্যাশানাল সার্ভিস কর্মসূচী প্রকল্পের বরাদ্দের ২৯২ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে আত্বসাত করেছেন সাবেক ডিডি ফারজানা পারভিনসহ ৬ জন কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ আদালতে একটি মামলা হয়। এবিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক ময়মনসিংহ জেলা শাখা তদন্ত করছে। জানাগেছে, ন্যাশানাল সার্ভিস কর্মসূচী প্রকল্পের বরাদ্দের ৪০% টাকা কানাডায় পাচার করেছেন এবং স্বামীর বাড়ি ভালুকায় প্রায় ৩ একক জমি কিনেছেন ডিডি ফারজানা পারভিন। এদিকে সাবেক আইজি বেনজির আহমেদের আস্তাভাজন ময়মনসিংহের ভালুকা মডেল থানার সাবেক ওসি মাহামুদুল ইসলাম হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবার নিয়ে চলে গেছেন। জানাগেছে, ওসি মাহামুদুল ইসলাম ময়মনসিংহ কোতোয়ালী,ভালুকা মডেল ও ত্রিশাল থানার ওসি থাকাকালে শতকোটি টাকা অর্জন করেছেন। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেকে সাছের পোনা নিতেন ওসি মাহামুদুল ইসলাম। ত্রিশালে এখনও পোনা ব্যাবসায়ীরা কয়েক কোটি টাকা বকেয়া পান। এই টাকার জন্য অনেক ব্যবসায়ী থানার সামনে কান্নাকাটি করেন। প্রচার আছে, ওসি মাহামুদুল ইসলাম পুলিশে চাকরী করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুদক ইতিমধ্যে খোঁজখবর রাখছেন। দুদকের মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে কথা বলতে আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রতিদিনের কাগজ। তবে তিনি ফোন ধরেননি।

 

 

গুলশানের ১৩৫ নম্বর রোডের এসইএস(এ)৬ নম্বর প্লটে এক বিঘা জমির ওপর নির্মিত ডুপ্লেক্স বাড়িটির বাজারদর ২০০ কোটি টাকার কম নয়। গেল আট বছর সেই সরকারি বাড়িটি অবৈধভাবে দখলে রেখেছেন এই শামসুদ্দোহা। এ সময়ে তিনি কোনো ভাড়া তো দেনইনি, উল্টো বাড়িটি তাঁকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। তবে তিনি পূর্বাচলে আরেকটি প্লট পাওয়ায় মন্ত্রণালয় সে আবেদন নাকচ করে দেয়। তবু তিনি বাড়িটি ছাড়েননি। তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদে আবাসন পরিদপ্তর একবার ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ দেয়। তবে পুলিশের প্রভাবশালী লোক হওয়ায় সে প্রক্রিয়াও থেমে যায়। এর পর আবাসন পরিদপ্তর আর কখনও তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর সাহস দেখায়নি।

 

 

জানা যায়, বিলাসবহুল ওই বাড়িতে একসময় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ থাকতেন। নূর মোহাম্মদ অবসরে গেলে ২০০৮ সালে পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শামসুদ্দোহা খন্দকারকে বসবাসের জন্য আবাসন পরিদপ্তর ওই বাড়ি বরাদ্দ দেয়। এ বাড়িতে থাকাকালে ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর শামসুদ্দোহা খন্দকার প্রেষণে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের ৪ মার্চ তিনি অবসর-উত্তর (পিআরএল) ছুটিতে যান। পিআরএলে থাকাকালেও এক বছর তিনি বাড়িটিতে থাকেন। পিআরএল শেষ হলেও তিনি বাড়ি ছাড়েননি। পরে বাড়িটি ছাড়তে তাঁকে আরও ছয় মাস সময় দেওয়া হয়। এর পরও শামসুদ্দোহা নাছোড়। ঢাকায় থাকার মতো তাঁর কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট না থাকার কারণ উল্লেখ করে ২০১৭ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়িটি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। পূর্ত মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দিলে তিনি আদালতে রিট করেন।

 

গেল ১৫ জানুয়ারি আদালত বাড়িটি সরকারের জিম্মায় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য রায় দেন। এর পর শামসুদ্দোহা খন্দকারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে আবাসন পরিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলামকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে অজানা কারণে ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উচ্ছেদ অভিযান চালাননি। ফলে বাড়িটি শামসুদ্দোহার দখলেই রয়ে যায়। এ ব্যাপারে আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক শহিদুল ইসলাম ভূঞা বলেন, ‘একজন ব্যক্তি একটি বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদে থেকে চাকরিজীবন শেষে এভাবে একটি বাড়ি দখল করে রাখে, তাহলে সে ধরনের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা আমার জন্য বিব্রতকর। কারণ তারা আমাদের চেয়ে অনেক সিনিয়র। তাদের সম্পর্কে আমার মতো কর্মকর্তার মন্তব্য করা মানায় না। গুলশানের সরকারি বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, নানা গাছপালায় ঘেরা শৈল্পিক আড়াই তলা ঘিয়ে রঙের বাড়িটির রয়েছে দুটি ফটক। একটি গাড়ি প্রবেশের, আরেকটি বের হওয়ার।

 

দোতলার সামনের দিকের বারান্দায় রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন ছাউনি। অভ্যন্তরে আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ধরনের গাছপালা। ফটকে খোঁজ নিলে এক নারী গৃহকর্মী বলেন, ‘স্যারের পরিবার কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছে। কবে আসবে, জানি না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বাড়িরই এক সাবেক গৃহকর্মী বলেন, ‘স্যারের গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। আবার পূর্বাচলে একটি বাড়ি তৈরির কাজ করছেন। সেখানে গেছেন কিনা জানি না। গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময়ে একাধিকবার ড. শামসুদ্দোহার মোবাইলে ফোন দিলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিতেও ফোন ঢুকছে না। তবে শামসুদ্দোহার ঘনিষ্ঠ একজন জানান, তাঁর এক মেয়ে ও ছোট ছেলে কানাডায় পড়াশোনা করে। বেনজীরকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ওঠার পর মনে হয়, পরিবার নিয়ে কানাডা বেড়াতে গেছেন।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |